আলোর রহস্য: তরঙ্গ নাকি কণা?

আলোর রহস্য: তরঙ্গ নাকি কণা?

আলো—একদিকে যেমন এটি আমাদের দেখার অনুভূতি জোগায়, অন্যদিকে তেমনি এটি পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে রহস্যময় ও আকর্ষণীয় বিষয়গুলোর মধ্যে একটি। আলোর প্রকৃতি নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক বহু শতাব্দীর পুরনো: আলো কি একটি তরঙ্গ নাকি ক্ষুদ্র কণা? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের এক যুগান্তকারী ধারণা জন্ম নিয়েছে—যা তরঙ্গ-কণা দ্বৈততা (Wave-Particle Duality) নামে পরিচিত।

 

কণা তত্ত্ব বনাম তরঙ্গ তত্ত্ব: ইতিহাসের দ্বন্দ্ব

 

আলোর প্রকৃতি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় ১৭শ শতকে।

  • স্যার আইজ্যাক নিউটনের কণা তত্ত্ব (Corpuscular Theory): নিউটন মনে করতেন আলো অসংখ্য ক্ষুদ্র কণার সমষ্টি, যা সরলরেখায় চলাচল করে। প্রতিফলন (Reflection) এবং প্রতিসরণের (Refraction) মতো ঘটনাগুলো এই তত্ত্বের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হলেও, আলোর অন্যান্য জটিল আচরণ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে এটি যথেষ্ট ছিল না।
  • ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনসের তরঙ্গ তত্ত্ব (Wave Theory): প্রায় একই সময়ে, ডাচ বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনস প্রস্তাব করেন যে আলো এক প্রকার তরঙ্গ, যা জলের ঢেউয়ের মতো বিস্তার লাভ করে। উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে টমাস ইয়াং-এর বিখ্যাত দ্বি-রেখাছিদ্র পরীক্ষা (Young's Double-slit Experiment)-এর মাধ্যমে আলোর ব্যতিচার (Interference) এবং অপবর্তন (Diffraction)-এর মতো তরঙ্গধর্মগুলি প্রমাণিত হয়। জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল আলোকে তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ হিসেবে গাণিতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করলে, তরঙ্গ তত্ত্বই বিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত সত্য হিসেবে জায়গা করে নেয়।

 

তরঙ্গ তত্ত্বের সংকট ও কোয়ান্টাম বিপ্লব

 

উনবিংশ শতাব্দীর শেষে এসে আলোর তরঙ্গ তত্ত্ব বেশ কিছু ঘটনা ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হলো, যা নতুন করে চিন্তার উদ্রেক ঘটাল:

১. আলোক-তড়িৎ ক্রিয়া (Photoelectric Effect): কোনো ধাতব পৃষ্ঠে আলো পড়লে যদি তা থেকে ইলেকট্রন নির্গত হয়, তবে আলোর তরঙ্গ তত্ত্ব অনুসারে উচ্চ উজ্জ্বলতার (তীব্রতা) আলো বেশি শক্তি নিয়ে আসায় তার বেশি ইলেকট্রন নির্গত করা উচিত ছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, ইলেকট্রনের নির্গমন আলোর কম্পাঙ্ক (Frequency)-এর ওপর নির্ভর করে, উজ্জ্বলতার ওপর নয়।

২. কৃষ্ণবস্তু বিকিরণ (Black Body Radiation): এই ঘটনাও তরঙ্গ তত্ত্ব দিয়ে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না।

এই সংকট নিরসনে এগিয়ে আসেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক এবং আলবার্ট আইনস্টাইন।

  • প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব: ১৯০০ সালে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক প্রস্তাব করেন যে শক্তি (আলো) অবিচ্ছিন্ন তরঙ্গের আকারে নির্গত না হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তি-গুচ্ছ বা প্যাকেট আকারে নির্গত হয়, যাদের নাম কোয়ান্টা
  • আইনস্টাইনের ফোটন ধারণা: ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন প্ল্যাঙ্কের এই ধারণাকে কাজে লাগিয়ে আলোক-তড়িৎ ক্রিয়া ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, আলোর এই কোয়ান্টা কণা হিসেবে আচরণ করে, যার নাম তিনি দেন ফোটন। প্রতিটি ফোটনের শক্তি ($E$) তার কম্পাঙ্কের ($\nu$) সমানুপাতিক: $E=h\nu$ (যেখানে $h$ হলো প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক)।

এই ব্যাখ্যা আলোর কণাধর্মকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করে। আইনস্টাইন ১৯২১ সালে এই কাজের জন্যই নোবেল পুরস্কার পান।

 

চূড়ান্ত উত্তর: তরঙ্গ-কণা দ্বৈততা (Wave-Particle Duality)

 

আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান এই বিতর্কটির অবসান ঘটিয়েছে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে আলো একইসঙ্গে তরঙ্গ এবং কণা উভয়ের ধর্ম প্রদর্শন করে। এটি একটি দ্বৈত সত্তা

  • আলো যখন তরঙ্গ: প্রতিফলন, প্রতিসরণ, ব্যতিচার, সমবর্তন, ও অপবর্তনের মতো ঘটনাগুলির ব্যাখ্যার জন্য আলো তরঙ্গ হিসেবে আচরণ করে।
  • আলো যখন কণা: আলোক-তড়িৎ ক্রিয়া, কৃষ্ণবস্তু বিকিরণ ইত্যাদির ব্যাখ্যার জন্য আলো ফোটন নামক কণা হিসেবে আচরণ করে।

একই সময়ে আলো তরঙ্গ এবং কণা হিসেবে প্রকাশিত হতে পারে না—কোন পরিস্থিতিতে আলোর কোন ধর্মটি প্রকাশিত হবে, তা নির্ভর করে পরীক্ষার প্রকৃতির ওপর। আলো, অন্যান্য সকল কোয়ান্টাম বস্তুর মতোই, এমন এক অদ্ভুত অস্তিত্ব যার সম্পূর্ণ বর্ণনা শুধুমাত্র সনাতন পদার্থবিজ্ঞানের 'তরঙ্গ' বা 'কণা'—কোনো একক ধারণার মাধ্যমে দেওয়া সম্ভব নয়।

 

উপসংহার

 

আলোর এই দ্বৈত রহস্য কেবল আলোর প্রকৃতিতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি কোয়ান্টাম বলবিদ্যার এক ভিত্তিগত ধারণা যা মহাবিশ্বের গভীরতম সত্যের দিকে ইঙ্গিত করে। এই আপাত-বিরোধী ধারণাটিই আমাদের শেখায় যে মহাবিশ্ব আমাদের সাধারণ অভিজ্ঞতার চেয়ে অনেক বেশি জটিল এবং কৌতূহলোদ্দীপক। আলোর এই রহস্য উন্মোচনই আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করেছে এবং বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে গেছে এক নতুন দিগন্তে।

DSC Logo DSC E-Store Logo E-Store