Blog Details

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ: মহাবিশ্বের অতীত দেখার জানালা
  • October 20, 2025
  • Admin
  • Comments (2)

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ: মহাবিশ্বের অতীত দেখার জানালা

মহাবিশ্বের দিকে তাকিয়ে থাকা মানুষের এক সহজাত প্রবৃত্তি। দূর আকাশের প্রতিটি নক্ষত্র যেন এক রহস্যের হাতছানি। এই অসীম মহাজাগতিক রহস্য উন্মোচনের এক নতুন এবং সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হলো জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (James Webb Space Telescope - JWST)। এটিকে কেবল একটি টেলিস্কোপ বললে ভুল হবে, এটি যেন এক অত্যাধুনিক টাইম মেশিন, যা আমাদের ১৩.৮ বিলিয়ন বছর পুরনো মহাবিশ্বের শৈশবে নিয়ে যেতে পারে।

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ হলো হাবল স্পেস টেলিস্কোপের যোগ্য উত্তরসূরি, যা নাসা (NASA), ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ESA) এবং কানাডীয় মহাকাশ সংস্থার (CSA) এক যৌথ প্রচেষ্টা। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে উৎক্ষেপণ হওয়া এই দূরবীণটি বর্তমানে পৃথিবী থেকে প্রায় ১৫ লক্ষ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ল্যাগ্রেঞ্জ পয়েন্ট ২ (L2) নামক একটি কক্ষপথে অবস্থান করছে।

 

কেন এটি "টাইম মেশিন"?

 

আমরা যখন রাতের আকাশে কোনো তারার দিকে তাকাই, তখন আমরা আসলে তার অতীত রূপ দেখি। কারণ সেই তারার আলো পৃথিবীতে এসে পৌঁছাতে একটি নির্দিষ্ট সময় লাগে। সূর্য থেকে আলো আসতে লাগে প্রায় ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড। তেমনি, একটি দূরবর্তী গ্যালাক্সি থেকে আলো আসতে যদি ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) বছর লাগে, তবে আমরা সেই গ্যালাক্সির ১ বিলিয়ন বছর আগের অবস্থাটিই দেখি।

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের ক্ষমতা এতটাই বেশি যে, এটি মহাবিশ্বের একদম শুরুতে, মহাবিস্ফোরণের (Big Bang) মাত্র কয়েকশ' মিলিয়ন বছর পরে গঠিত হওয়া প্রথম গ্যালাক্সিগুলির আলোকেও ধরতে সক্ষম। ১৩৫০ কোটি বছর আগের সেই ক্ষীণ আলো যখন এটি সংগ্রহ করে, তখন আমরা আক্ষরিক অর্থেই মহাবিশ্বের একদম শুরুর দিকের ছবি দেখতে পাই—যা আগে কোনো টেলিস্কোপের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। এই কারণেই JWST কে "মহাবিশ্বের অতীত দেখার জানালা" বলা হয়।

 

ইনফ্রারেড আলো: অতীতের চাবিকাঠি

 

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের প্রধান পার্থক্য হলো, এটি দৃশ্যমান আলোর পরিবর্তে অবলোহিত (Infrared) আলো নিয়ে কাজ করে। কিন্তু কেন?

মহাবিশ্ব প্রতিনিয়ত প্রসারিত হচ্ছে। এর ফলে খুব দূরের কোনো উৎস থেকে আসা আলো যখন মহাবিশ্বের মধ্য দিয়ে আমাদের দিকে আসে, তখন তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রসারণের কারণে তা প্রসারিত হয়ে যায়। দৃশ্যমান আলো ধীরে ধীরে দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অবলোহিত আলোতে (Redshift) রূপান্তরিত হয়। এই প্রক্রিয়াটি অনেকটা সাইরেনের শব্দের মতো, যা কাছে থাকলে একরকম আর দূরে গেলে অন্যরকম শোনায়।

ফলে, আদিম মহাবিশ্বের গ্যালাক্সিগুলি থেকে আসা দুর্বল ও প্রসারিত আলো এখন আর দৃশ্যমান থাকে না—তা অবলোহিত আলোতে পরিণত হয়। JWST বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছে সেই ইনফ্রারেড আলো ধরার জন্য। এর উন্নত সেন্সর এবং প্রযুক্তির সাহায্যে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের জন্ম মুহূর্তের সেই সব ছবি ও তথ্য বিশ্লেষণ করতে পারেন, যা দৃশ্যমান আলোয় ঢাকা পড়ে যেত।

 

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের বিশেষত্ব

 

এই অত্যাধুনিক টেলিস্কোপের কিছু অবিশ্বাস্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে:

  • বিশাল প্রাথমিক আয়না: JWST-এর প্রাথমিক আয়নাটি স্বর্ণের প্রলেপযুক্ত ১৮টি ষড়ভুজাকার খণ্ড দিয়ে গঠিত, যার মোট ব্যাস ৬.৫ মিটার (২১ ফুট)। এটি হাবল টেলিস্কোপের আয়নার চেয়ে প্রায় ছয় গুণ বড়। আয়না যত বড় হবে, এটি তত বেশি আলো সংগ্রহ করতে পারবে এবং তত বেশি দূরের বস্তু দেখতে পারবে।
  • সোনালী আবরণ: এই আয়নায় ব্যবহৃত সোনার প্রলেপ অবলোহিত আলোকে খুব ভালোভাবে প্রতিফলিত করে।
  • সূর্যরক্ষা আবরণ (Sunshield): JWST-এর চারটি স্তরবিশিষ্ট একটি বিশাল সূর্যরক্ষা আবরণ রয়েছে, যা টেলিস্কোপের সংবেদনশীল অংশগুলিকে সূর্য, পৃথিবী এবং চাঁদের তাপ থেকে রক্ষা করে। টেলিস্কোপের যন্ত্রাংশগুলিকে প্রায় $-২২৩°C$ তাপমাত্রায় শীতল রাখা হয়, যাতে তা নিজস্ব তাপ বিকিরণ না করে এবং দূরবর্তী দুর্বল অবলোহিত আলো সহজেই সনাক্ত করতে পারে।

 

ভবিষ্যৎ অনুসন্ধান

 

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ শুধুমাত্র মহাবিশ্বের প্রাচীনতম গ্যালাক্সি দেখেই থেমে নেই। এর লক্ষ্য আরও সুদূরপ্রসারী:

  • প্রথম নক্ষত্রের জন্ম: এটি মহাবিশ্বের "অন্ধকার যুগ" পেরিয়ে প্রথম নক্ষত্র ও গ্যালাক্সিগুলির গঠন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করছে।
  • গ্রহাণু এবং তারার জন্ম: ধূলিমেঘের আড়ালে থাকা তারার জন্মস্থান (নেবুলা) এবং নতুন গ্রহাণু তৈরির প্রক্রিয়া স্পষ্ট দেখতে পারছে।
  • বহির্জাগতিক গ্রহ (Exoplanets): এটি আমাদের সৌরজগতের বাইরের গ্রহগুলির বায়ুমণ্ডল বিশ্লেষণ করছে, যা সেখানে জীবনের উপযোগী উপাদান (যেমন জলীয় বাষ্প বা অক্সিজেন) খোঁজার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 

উপসংহার

 

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ মানবজাতির প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের এক অসাধারণ নিদর্শন। এটি কেবল পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র বা জ্যোতির্বিজ্ঞানের জ্ঞানকে প্রসারিত করছে না, বরং মহাবিশ্বে আমাদের স্থান সম্পর্কেও আমাদের ধারণাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছে। এর তোলা প্রতিটি ছবিই যেন মহাবিশ্বের ইতিহাসের একটি পাতা—যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমরা নক্ষত্রের ধূলিকণা থেকে জন্ম নেওয়া এক কৌতূহলী জাতি, যারা এখনও নিজেদের মহাজাগতিক উৎস খুঁজছে।

Tags:

Category: